ঢাকা , মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫ , ১০ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে বড় হাটে বেচাকেনা হয় কোটি টাকার লাল মরিচ

​পাল্টে যাচ্ছে উত্তরের অর্থনীতি

স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় : ২৪-০৬-২০২৫ ০৩:৩২:১৮ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ২৪-০৬-২০২৫ ০৩:৩২:১৮ অপরাহ্ন
​পাল্টে যাচ্ছে উত্তরের অর্থনীতি সংবাদচিত্র: সংগৃহীত
কাক ডাকা ভোর থেকেই চরাঞ্চলের কৃষকরা শুকনো লাল মরিচ নিয়ে ছুটে আসেন হাটে। সাদা বস্তায় টকটকে লাল মরিচ। এটি গাইবান্ধার ফুলছড়ি হাটের চিরচেনা রূপ। ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর অস্থায়ী এই হাট দেশের উত্তরাঞ্চলের অন্যতম বড় মরিচের পাইকারি হাট। এই হাটে সপ্তাহে দুইদিনে কয়েক কোটি টাকার লাল মরিচ বিক্রি হয়। এতেই এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে বইছে সুবাতাস। পাল্টে যাচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতি। 

গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে ফুলছড়ি উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের পুরাতন হেডকোয়ার্টার এলাকায় বসে এই ঐতিহ্যবাহী হাট। হাটটি অনেকের কাছে লাল মরিচের হাট নামেই পরিচিত। সপ্তাহে শনিবার ও মঙ্গলবার হাট বসে। সকাল গড়িয়ে দুপুর পর্যন্ত চলে কোটি টাকার মরিচ বেচা-কেনা। তবে এই হাটের নিজস্ব কোনো ঠিকানা নেই। নদের ওপর জেগে ওঠা ব্যক্তি মালিকানাধীন জায়গায় বসে হাট।জানা গেছে, গাইবান্ধার সদর, সাঘাটা, সুন্দরগঞ্জ ও ফুলছড়ি এই চার উপজেলার ১৬৫টি চরে উল্লেখযোগ্য হারে মরিচের চাষ হয়। এসব চরের উৎপাদিত শুকনো মরিচ বেচাকেনা হয় এই হাটে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ছাড়াও জামালপুর, নওগাঁ, রাজশাহী, দিনাজপুর, বগুড়া, রংপুর ও রাজধানীসহ দেশের নানা প্রান্ত থেকে মরিচ কিনতে এখানে আসেন পাইকাররা। এছাড়া দেশের নামকরা প্যাকেটজাত খাদ্য প্রস্তুত কোম্পানির প্রতিনিধিরাও এখান থেকে নিয়মিত মরিচ সংগ্রহ করে থাকেন।

সরেজমিনে লাল মরিচের হাটে গিয়ে দেখা যায়, ফুলছড়ি উপজেলার ব্রহ্মপুত্রের ঘাটে দ্রুত গতিতে একের পর এক ছুটে আসছে নানা আকারের নৌকা। প্রতিটি নৌকায় বোঝাই করা রয়েছে সাদা বস্তা, যার ভেতরে ঠাসা লাল মরিচ। নৌকাগুলোর সঙ্গে আছে মানুষও। কেউ চালক, কেউবা সহকারী। সবাই ব্যস্ত নিজেদের কাজে। এসময় নদী যেন একটি ভাসমান জীবনে পরিণত হয়। যেখানে এক মুহূর্তের জন্যও জীবনের গতি থেমে নেই। হাটবারে ভোর থেকেই নদীর ঘাটে এমন ব্যস্ততা চোখে পড়ে। ঘাটে নৌকা ভিড়লে ঘাটজুড়ে উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়।ঋতু ভেদে নৌকা ঘাট থেকে মরিচের হাটে যেতে পাড়ি দিতে হয় প্রায় আধা কিলোমিটার পথ। কোনো কোনো সময় আরও বেশি। নৌকা থেকে নেমেই চরাঞ্চলের কৃষকরা ছুটে চলেন হাটের দিকে। যাদের সঙ্গে অল্প পরিমাণ মরিচ, তারা কেউ মাথায়, কেউ ভার সাজিয়ে হেঁটে চলেন বালুপথ ধরে। যারা বেশি পরিমাণ মরিচ নিয়ে আসেন তারা ঘোড়ার গাড়িতে করে মরিচ বহন করছেন হাটে পৌঁছানোর জন্য।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় লাল মরিচের বেচা কেনা। ক্রেতা-বিক্রেতার দরদামে মুখরিত হয়ে ওঠে হাটের মাঠ। মরিচের জাত, আকার ও মান ভেদে দাম নিয়ে চলে ক্রেতা-বিক্রেতার তোড়জোর। এই হাটে মান ভেদে তিন ধরনের মরিচ পাওয়া যায় উত্তম, মধ্যম ও নিম্ন মানের। মৌসুম ভেদে ভিন্ন ভিন্ন দামও থাকে মরিচের। সকাল থেকে শুরু হওয়া হাটের বেচাকেনা চলে দুপুর দুইটা পর্যন্ত। হাটজুড়ে সরব উপস্থিতি থাকে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা পাইকারদের।

স্থানীয় বিক্রেতা ও ব্যবসায়ীরা জানান, ফুলছড়ির চরাঞ্চলের মরিচ মানে ভালো মানের পণ্য। এক জায়গায় এতো ভালো মানের মরিচ আর কোথাও মেলে না। তাই দূরদূরান্ত থেকে ক্রেতারা ছুটে আসেন এই হাটে। তবে চলতি মৌসুমে মরিচের দাম নিয়ে অসন্তুষ্ট কৃষকরা। একাধিক কৃষকের অভিযোগ, উৎপাদন খরচের তুলনায় বাজারদর কম হওয়ায় তারা প্রত্যাশিত লাভ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। গজারিয়া ইউনিয়নের গলনাচরের মরিচ বিক্রেতা হাসমত আলী বলেন, ‘এই হাটে মরিচ বিক্রি করতে আসছি। চার বিঘা জমিতে মরিচের আবাদ করেছি। ফলন ভালো হয়েছে। এবার মরিচের তেমন দাম নাই। মরিচ বেচে ট্যাকা উটপে না।’ রতনপুর থেকে আসা কৃষক আসগর আলী  বলেন, এ বছর মরিচের দাম কিছুটা কম। গেলো বছর ৯ হাজার থেকে ১২ হাজারো পর্যন্ত ছিল প্রতিমণ মরিচের পাইকারি দাম। কিন্তু এ বছর ৮ হাজার দিয়ে শুরু হলেও পরে ছয় ও শনিবার পাঁচ হাজার টাকা বলেছে পাইকাররা। ফজলুপুর ইউনিয়নের খাটিয়ামারি চরের কৃষক জাহিদ প্রমাণিক বলেন, প্রতিবিঘা মরিচ উৎপাদনে খরচ হয় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। কাঁচামরিচ ৪০ থেকে ৫০ মণ হলেও শুকিয়ে তা ৭-৮ মণ হয়। দশ হাজার টাকা মণ বিক্রি করতে পারলে নিজের খাটুনি বাদে ২০ হাজারের মতো লাভ হয়। এবার দাম কম, বেশি একটা লাভ হবে না।

নওগাঁ থেকে হাটে আসা মরিচের পাইকারি ব্যবসায়ী শাহা পরাণ সুলতান বলেন, দীর্ঘদিন থেকেই এই হাটে শুকনো মরিচ কিনি। এখানকার মরিচের মান অনেক ভালো, প্রচুর চাহিদা রয়েছে। এই হাটে মরিচ কিনে সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করি। বগুড়ার পাইকারি ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা নিয়মিত এই হাট থেকে মরিচ ক্রয় করে থাকি। দূরের ব্যবসায়ীরা এখানে আসি, কিন্তু এখানে আমাদের রাতে থাকার ব্যবস্থার সংকট রয়েছে। তাছাড়া কোনো অসুবিধা নেই।

হাট ইজারাদার অহিদুল ইসলম বলেন, এটি উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে বড় মরিচের হাট। এখানে জেলার চরাঞ্চলের কৃষকরা মরিচ বিক্রি করে থাকেন। দেশের বিভিন্ন জেলার পাইকাররা এবং বিভিন্ন কোম্পানি এখানে মরিচ কিনতে আসেন। প্রতি হাটে সোয়া কোটি থেকে দুই কোটি টাকার মরিচ বেচা-কেনা হয়ে থাকে। গাইবান্ধা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক খোরশেদ আলম বলেন, চরাঞ্চলের মাটি মরিচ চাষের জন্য। চরের লোকজনও মরিচ চাষে ঝুঁকছে। তারা মরিচ চাষ করে স্বাবলম্বী হচ্ছে। চাষাবাদ ভালো করার জন্য কৃষি বিভাগ থেকে কৃষকদের পরামর্শসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আসছি। গাইবান্ধার শুকনো লাল মরিচের কদর রয়েছে দেশজুড়ে। মরিচ চাষে চরাঞ্চলের মাটির গুণাগুণ ও আবহাওয়া ভালো হওয়ায় মরিচের আকার বড় ও সুন্দর হয়। অন্যান্য মাটির তুলনায় চরের মাটিতে মরিচের ফলন দুই থেকে তিনগুণ বেশি হয়। জেলার ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, যমুনা ও করতোয়া নদীবেষ্টিত চরগুলোতে শত শত বিঘা জমিতে মরিচের চাষ হয়। সাধারণত বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরই চরের পলি মাটিতে দুই থেকে তিনটি চাষ দিয়ে মই দেওয়ার পর বীজ বোনা হয়। গাছ একটু বড় হলে ১৫-২০ দিন পরপর ২-৩ বার নিড়ানি দিলেই বিনা সারে বিস্তর ফলন হয় মরিচের। উৎপাদনে খরচও অনেকটা কম।

বাংলাস্কুপ/প্রতিনিধি/এনআইএন
 


প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স


এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ